ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ‘ভূমিকম্প- সম্ভাব্য অঞ্চলে’ অবস্থিত। তবে অবকাঠামো নির্মাণে ভূমিকম্পের ঝুঁকির বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিগত দশকগুলোয় বেশ কয়েকটি ছোটখাটো ভূমিকম্প হলেও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে গুনগত মান নিশ্চিত না হবার বিষয়টি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।
সম্প্রতি তুরস্কে ভূমিকম্পে বিপুল হতাহতের ঘটনায় ভবন নির্মাণে নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে।
প্রকৌশলীরা বলছেন, ঝুঁকি থাকলেও গত দুই দশকে ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য তেমন পরিবর্তন হয়নি। তাদের মতে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড আইন থাকলেও, এর বাস্তবায়ন না হবার কারণে এমনটা হচ্ছে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি
১৮৭০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বড় আকারের বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প দেখেছে বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে ছোট ছোট কিছু ভূমিকম্প হলেও বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্পের মুখোমুখি হতে হয়নি।
তবে গত ১০০ বছরে বড় কোনো ভূমিকম্প না হওয়ায় ছোট কম্পনগুলো শক্তি সঞ্চয় করে সামনে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা তৈরি করছে বলে মনে করছেন ভূতত্ত্ববিদরা। আর ভূমিকম্পের সময় হতাহতের বড় একটি কারণই ভবন ধস। তারপরেও ভবন নির্মাণের শর্তগুলো মানা হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, গত দুই দশকে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত উপাদানের মান উন্নয়ন হলেও, সার্বিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। তার মতে, উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে বেশ বড় অংকের বিনিয়োগ থাকায় নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেছে। কিন্তু পাঁচ থেকে ছয় তলা ভবন নির্মাণে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
মেহেদি আহমেদ আনসারীর সঙ্গে অনেকটাই একমত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান।
তিনি বলছেন বিভিন্ন সময়ে নানা প্রকল্পের আওতায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা হয়, তবে শেষ পর্যন্ত বাস্তবভিত্তিক পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় নয়।
তবে আবাসন নিয়ে কাজ করে এমন একটি সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাউজিং এন্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ শফিউল ইসলাম বলছেন, ধীর গতিতে হলেও ভবনকে ভূমিকম্প সহনশীল করতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
ভূগর্ভস্থ মাটির অবস্থা, পানির স্তর- এসব কিছু কারণে ছোট ভূমিকম্পেও বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের আশক্ষা আছে বলে মনে করেন শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান।
তিনি বলছেন এ নিয়ে একাধিক প্রকল্পের অধীনে ঝুঁকি বিশ্লেষণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও এটি ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন কয়েকটি ভবন। বিশ্লেষকরা বলছেন নির্মাতাদের সামর্থ্য, ইচ্ছা ও আইন মানার প্রবণতাই এর কারণ।
এই সীমিত সংখ্যাকে যদি সার্বিকভাবে বাড়ানো যায় তবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
তবে প্রকৌশলী শফিউল ইসলাম মনে করেন গত ১০ বছরে নির্মাণ করা ভবনে বৈজ্ঞানিক ডিজাইন কোড মানা হয়েছে।
তার আগে নির্মিত ভবনগুলো নিয়ে শঙ্কা থাকলেও পরবর্তী সময়ের ভবনগুলো ভূমিকম্প-সহনশীল বলেই মত তার।
আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই
১৯৯৩ সালে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ প্রণয়ন করা হলেও, আইনি জটিলতার কারণে ১৩ বছর পরে ২০০৬ সালে এটিকে গেজেট হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
তবে সময়োপযোগী না হওয়ায় এবং পেশাজীবীদের দাবির মুখে ২০২১ সালে এই কোড সংশোধন করা হয়। ভবন নির্মাণে ন্যূনতম মান নিশ্চিত করাই ছিল এই আইনের লক্ষ্য।
‘বিল্ডিং কোড হলে পৃথিবীব্যাপী ভবন নির্মাণের গুনগত মানেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু বাংলাদেশে আইনই ঠিকঠাক প্রণয়ন হয়নি, সেখানে মানের পরিবর্তন হবে কিসের ভিত্তিতে? বলছেন শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান।
এই আইনের আওতায় বিল্ডিং রেগ্যুলেটরি অথরিটি নামে আলাদা একটি বিভাগের পরিকল্পনা ছিল, যাদের কাজ হবে ভবনের সার্বিক তত্ত্বাবধান। কিন্তু সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলছেন, ঢাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট অঞ্চলের তদারকির দায়িত্বে থাকলেও পুরো দেশে ভবনের মান দেখাশোনার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।
খবর বিবিসি বাংলা
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।